ছাড়পত্র নিয়ে জটিলতা প্রাথমিকে। কাগজ নিয়ে সংকট মাধ্যমিকে। আজ দুই মন্ত্রণালয়ের যৌথ সভা।
-
প্রাথমিকের বই ৯ কোটি ৯২ লাখ ৮৩ হাজার।
-
মাধ্যমিক স্তরের বই ২৩ কোটি ৮২ লাখ ৭০ হাজার ৫৮৮টি।
-
ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর শিক্ষার্থীদের মাতৃভাষায় লেখা বই ২ লাখ ১২ হাজার ১৭৭টি।
নতুন শিক্ষাবর্ষ শুরু হতে মাত্র দুই মাস বাকি। কিন্তু নানা জটিলতায় গতকাল মঙ্গলবার পর্যন্ত প্রাথমিক স্তরের পাঠ্যবই ছাপার কাজ শুরুই করা যায়নি। অথচ অন্যান্যবার এই সময়ে বিপুল পরিমাণ বই ছাপা হয়ে যায়। প্রাথমিকে মোট পাঠ্যবই ১০ কোটির মতো। মাধ্যমিক স্তরে বই ছাপার কাজ শুরু হলেও এখন কাগজ নিয়ে সংকট তৈরি হয়েছে।
অভিযোগ উঠেছে, কাগজের দাম বেড়ে যাওয়ার অজুহাতে নিম্নমানের কাগজ দিয়ে বই ছাপার পাঁয়তারা করছেন মুদ্রণকারীদের অনেকেই। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) কর্মকর্তা ও মুদ্রণকারীদের আশঙ্কা, হাতে যে সময় আছে, তাতে আগামী শিক্ষাবর্ষের শুরুর দিনে সব শিক্ষার্থীর হাতে সব বই দেওয়া কঠিন হবে। শেষ পর্যন্ত আংশিক বই দিয়েও উৎসব করা হতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে।
অথচ করোনাকাল বাদে ২০১০ সাল থেকে দেশে উৎসব করে বছরের প্রথম দিন শিক্ষার্থীদের হাতে বিনা মূল্যের সব পাঠ্যবই তুলে দেওয়া হচ্ছে।
পাঠ্যবই ছাপানোর কার্যাদেশ দিতে দেরি করা, প্রাক্কলিত দরের চেয়ে কম দামে কাজ পাওয়াসহ কয়েকটি কারণে এবার আগে থেকেই সময়মতো শিক্ষার্থীদের হাতে মানসম্মত সব বই তুলে দেওয়া নিয়ে শঙ্কা দেখা দিয়েছিল। এখন শেষ সময়ে এসে বই ছাপার ছাড়পত্র দিতে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের দেরি করা, কাগজের সংকটসহ কয়েকটি কারণে সমস্যা আরও ঘনীভূত হয়েছে।
পরিস্থিতি মোকাবিলায় আজ বুধবার শিক্ষা ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মধ্যে যৌথ সভা ডাকা হয়েছে।
এনসিটিবির চেয়ারম্যান মো. ফরহাদুল ইসলাম গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, মাধ্যমিক স্তরের বই নিয়ে সমস্যা হবে না। তবে প্রাথমিকের বই নিয়ে কিছুটা জটিলতা আছে। তাঁরা আশা করছেন, আজকের বৈঠকের পর জটিলতা দূর হয়ে যাবে।
আগামী শিক্ষাবর্ষের জন্য প্রায় ৩৪ কোটি বই ছাপানোর কাজ চলছে। এর মধ্যে প্রাথমিক স্তরের (প্রথম থেকে পঞ্চম শ্রেণি) বই প্রায় ১০ কোটি, প্রাক্-প্রাথমিকের বই ৬৩ লাখের বেশি এবং ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর মাতৃভাষায় রচিত বই ২ লাখের বেশি। মাধ্যমিক স্তরের বইয়ের সংখ্যা ২৩ কোটি ৮২ লাখ ৭০ হাজার ৫৮৮টি। এবার প্রাথমিকের প্রথম শ্রেণি এবং মাধ্যমিক স্তরের ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের জন্য নতুন শিক্ষাক্রমের আলোকে পাঠ্যবই ও শিক্ষক গাইড দেওয়া হচ্ছে। অন্যান্য শ্রেণির জন্য আগের শিক্ষাক্রমে হচ্ছে।
প্রাথমিক নিয়ে বড় সংকট
বই ছাপার কাজটি করে এনসিটিবি। তৃতীয় শ্রেণি থেকে পঞ্চম শ্রেণির প্রায় সাত কোটি বই ছাপার জন্য দরপত্র অনুযায়ী ২১টি প্রতিষ্ঠান চুক্তি করেছে। কিন্তু কাজ শুরু করতে পারেনি। ছাপা শুরু করতে না পারার অন্যতম কারণ, নিয়ম অনুযায়ী বই ছাপার কাজ শুরুর আগে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের ছাড়পত্র লাগে। কিন্তু তা দিতে দেরি হচ্ছে। অথচ গত মাসের ১১ থেকে ১৩ অক্টোবরের মধ্যে ছাড়পত্রের জন্য প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরে পত্র পাঠানো হয়েছিল।
আবার কোনো কোনো প্রতিষ্ঠানের কাগজের মান নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। চারটি প্রতিষ্ঠানের কাগজ নিম্নমানের হওয়ায় সেসব কাগজ বাতিল করা হয়েছে। এরপর অন্য অনেক মুদ্রণকারী ছাড়পত্রের জন্য কাগজ পরীক্ষা করাতে আবেদনই করেনি।
বই ছাপার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, মানের ক্ষেত্রে কোনো আপস করা হবে না। কিন্তু ছাড়পত্র দিতে দেরিও করা যাবে না।
উল্লেখ্য, এনসিটিবি বই ছাপার কাজটি করলেও প্রাথমিক স্তরের ছাপার টাকা দেয় প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর।
বিদ্যমান পরিস্থিতিতে প্রাথমিক স্তরের কাজ পাওয়া তিনটি মুদ্রণকারী প্রতিষ্ঠান ছাপার জন্য চুক্তিও করেনি। এই তিনটি প্রতিষ্ঠান প্রায় ৭৬ লাখ বই ছাপার কথা ছিল। এ ছাড়া প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির প্রায় তিন কোটি বই ছাপার জন্য কার্যাদেশই দেওয়া যায়নি। এ বিষয়ে এখন পর্যন্ত মন্ত্রণালয় থেকে অনুমোদন পাওয়া যায়নি বলে জানা গেছে।
মাধ্যমিকে কাগজ নিয়ে আশঙ্কা
মাধ্যমিক স্তরের প্রায় ২৪ কোটি বই ছাপার কাজ করছে ৭৮টি মুদ্রণকারী প্রতিষ্ঠান। এনসিটিবির সূত্রমতে, ৩১ অক্টোবর পর্যন্ত ৩ কোটির বেশি বই ছাপা হয়েছে। এর মধ্যে সরবরাহ করার জন্য ছাড়পত্র পেয়েছে ১ কোটি ৬৬ লাখের বেশি বই।
বই ছাপার কাজসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে গেছে, গতকাল থেকেই কাগজের সংকট বড় করে সামনে এসেছে। এ কারণে গতকাল অনেক ছাপাখানায় কাজ বন্ধ ছিল। এর মূল কারণ কাগজের দাম অস্বাভাবিক বৃদ্ধি। ৬০ থেকে ৭০ জিসিএমের (পুরত্ব) কাগজ দিয়ে মাধ্যমিকের বই ছাপার কাজ চলছে। আর প্রাথমিকের সঙ্গে মিল রেখে ইবতেদায়ি স্তরের বই ছাপা হচ্ছে ৮০ জিসিএমের কাগজ দিয়ে।
এনসিটিবির একজন কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, মুদ্রণকারীদের একটি অংশ শেষ সময়ে এসে নিম্নমানের কাগজ দিয়ে বই ছাপার কাজ করে থাকেন। এবারও সেই পাঁয়তারা চলছে।
এ ছাড়া কিছু বইয়ের পাণ্ডুলিপিও সংশোধন করতে হচ্ছে। সব মিলিয়ে সময়মতো মানসম্মত সব বই ছাপানো নিয়ে শঙ্কাটি আরও বেড়েছে।
মুদ্রণশিল্প সমিতির সাবেক সভাপতি তোফায়েল খান প্রথম আলোকে বলেন, ‘প্রথমত, এবার এনসিটিবি দরপত্রের কাজটিই দেরিতে শুরু করেছে। এখন কাগজের সংকট তীব্র হয়েছে। আবার লোডশেডিংয়ের সমস্যাও আছে। আমরা আপ্রাণ চেষ্টা করছি। কিন্তু বছরের শুরুতে সব বই দেওয়ার মতো আশার আলো দেখছি না।’